করোনায় আটকে পড়া কানাডিয়ান বাংলাদেশিদের কথা
কানাডা থেকে বাংলাদেশে গিয়ে আটকা পড়েছেন প্রায় হাজার খানেক বাংলাদেশে। তারা প্রত্যেকেই গভীর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাপন করেছেন। দীর্ঘ তিন-চার মাস পর তাদের কেউ কেউ কানাডায় ফিরছেন। ইতোমধ্যে কাতার এয়ারলাইন্সের দুইটি চার্টার বিমান গত ১৪ এপ্রিল এবং ১৬ এপ্রিল ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছে প্রায় পাঁচশ’ যাত্রী। এদের মধ্যে ফেরত দুইজন এবং ঢাকায় আটকে পড়া দুইজন ইত্তেফাকের কাছে নানান অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছেন।
কাতার এয়ারলাইন্সের কিউ আর ৭৪৮৪ এবং কিউ আর ৭৬৩ ফ্লাইটে ফেরত আসা এম এ কাদের মিলু ফিরেই মেসি স্কয়ারে নিজ ফ্ল্যাটে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। তিনি ওয়ান ওয়ে ভাড়া দিয়েছেন চার হাজার ডলারের উপরে!
তারপরও ঢাকাস্থ কানাডিয়ান দূতাবাসের প্রচেষ্টা এবং ভূমিকার প্রশংসা করে মিলু বলেন, আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ের জন্য অস্থির ছিলাম। ঢাকাতেও ছিলাম গৃহবন্দি। অথচ চলে আসার সময় লকডাউনের কারণে আশি বছর বয়স্ক মাকেও এক নজরে দেখে আসতে পারলাম না। একদিকে মা, অন্য দিকে পরিবার; ফলে দুই কূল রক্ষা করা হয়না। আর কানাডায় এসেই দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মীর বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাম শরীফের করোনায় করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছিনা। এ কেমন মৃত্যু যে, স্বজনকে শেষ বিদায় দেয়ার সামান্য সুযোগ থেকে সবাই বঞ্চিত!
মিরপুরে আটকে পড়া লুৎফুন নেসা টার্কিশ বিমানে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফেরার কথা ছিলো আরো পরে। কিন্তু বিশ্বের ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে কানাডা সরকারের ঘোষিত সিদ্ধান্তে তার আগেই টরন্টোতে ফিরলেন। ফিরেই বিমান বন্দর থেকে সরাসরি ক্রিসেন্ট টাউনের ফ্ল্যাটে কোয়ারেন্টাইনে ঢুকেন। পিয়ারসন বিমান বন্দর থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বিমান গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। কারণ, যাত্রীকে রিসিভ করা নিষিদ্ধ। সবার কাছে ‘বুবু’ বলে পরিচিত লুৎফুন নেসা হুইল চেয়ারের যাত্রী হয়েও যাত্রাপথে নানান বিড়ম্বনায় পড়েন।
তিনি তা উল্লেখ করে বলেন, ঢাকা বিমানে উঠার সময় আমাদের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু তা বিধি সম্মত নয়। কারণ, একই জিনিস দিয়ে অনেক যাত্রীকে টেস্ট করা হচ্ছে। আমি প্রতিবাদ করেছি।
আমরা কানাডা সরকারের দেয়া পাঁচ হাজার ডলার লোন নিতে এসেছি। কিন্তু এতো টাকার বদলে তাদের সার্ভিস ভালো ছিলোনা। শুধু বিমানে উঠার পর একবার নাস্তা দেয়া হয়। পরে পানির ব্যবস্থাও ছিলোনা। দোহায় টানা আট ঘণ্টার ট্রানজিটেও প্রায় সব বাথরুম বন্ধ ছিলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে কি থাকা সম্ভব? ফলে এতো টেনশনের মধ্যে অনেক যাত্রী আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। প্রতিটি বিমান বন্দর একেবারে ফাঁকা মাঠ।
তিনি মন্টিয়লে এসে দেখেন, তার জন্য টরন্টো কানেক্টেড ফ্লাইটের বুকিং নেই, হুইল চেয়ার নেই, বিমানের লোকজন নেই। পরে এয়ার কানাডার কাউন্টের গেলে তার কাছে আবার ভাড়া চাওয়া হয়। অবশেষে পিয়ারসনের আসার বুকিং মেলে।
অপর দিকে এখনো ঢাকায় শত শত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান আটকে আছেন। তাদের মধ্যে দু’জনের সাথে ইত্তেফাকের কথা হয়েছে। তাদের একজন বিশিষ্ট শিল্পী এবং লেখক দিনু বিল্লাহ। নায়গ্রাবাসী দিনু বইমেলার টানে গত ১৮ জানুয়ারি স্ত্রীসহ বেড়াতে গিয়ে এখন চামেলিবাগে গৃহবন্দি। সৌদি এয়ারলাইন্সে ফেরার কথা ছিলো ৩১ মার্চ। তাঁরা ফেরার জন্য অস্থির।
দিনু বলেন, এবার বইমেলায় অনন্যা থেকে আমার নতুন বই ‘মিলিত প্রাণের কলরব’ বের হলো। আর সেজন্য অনেকটা দেশে আসা। আমার ঔষধ-পত্র প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই চিন্তিত। এখন সকল বিমান বন্ধ। কবে স্বাভাবিক হবে, কেউ বলতে পারছে না। তাই কানাডিয়ান সরকারের এই প্রকল্পে ফেরার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের মতো আটকে পড়া শিল্পী নাহিদ কবিরও দূতাবাসের মাধ্যমে ফেরার চেষ্টা করেছেন।
দিনু বিল্লাহ’র নিকটতম আত্মীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ জানান, যদিও এখানে বিকল্প মেডিসিন পাওয়া যায়। তবু দিনু ফেরত যাবার জন্য উদগ্রীব। সার্বিক পরিস্থিতির কারণে একটা মানসিক অস্থিরতা বিরাজ করছে।
বাঙালি পাড়া বলে খ্যাত টরন্টোস্থ টিসড্যালের বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন। একমাত্র মেয়ে অদ্বিতির বিয়ের জন্য সপরিবারে গিয়ে ছিলেন বাংলাদেশে। এমিরেটস এয়ারলাইন্সে ফেরার কথা ছিলো ২৫ মার্চ। যথারীতি এমিরেটস বন্ধ। তারা টাকাও ফেরত দিবে কিনা বলা মুশকিল।
জাকির অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, জাস্টিন প্রতিদিনই বড় বড় কথা বলে কানাডার সকল নাগরিকদের নানান নিরাপত্তা, বেঁচে থাকার ‘ফ্রি’ সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা করছে। আর আমাদের মতো আটকে পড়া কানাডিয়াদের ফেরত নেয়ার জন্য লোন ঘোষণা করছে। কেন এই দ্বৈতনীতি!
জাকির স্থায়ীভাবে চিকিৎসাধীন জীবন-যাপন করছেন।নিয়মিত একাধিক ওষুধ খেতে হয়। সেই ওষুধপত্র প্রায় শেষ। এ অবস্থায় এই সব নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠায় অস্থির জাকির। তিনি বলেন, এখানের চিকিৎসা ব্যবস্থা আর কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থা এক নয়। যদি শরীর খারাপ হয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে কি হবে জানিনা।
যদিও গফরগাঁও চমৎকার মনোরম পরিবেশে গ্রামের বাড়িতে আছি। মায়ের কাছে আছি। তারপরও এখন ফেরাটা জরুরি। কারণ, আমার বাড়ির আঙ্গিনায় মসজিদ।এখানে কেউ আইন মানে না। মসজিদে নিয়মিত জামাতের নামাজ হচ্ছে। সোলাল ডিসটেন্স বলে কিচ্ছু নেই। বাজারে, মসজিদে মানুষের ভিড়। আমি করোনার ভাইরাসের ভয়ে আছি। আমি আতংকিত! আমি দ্রুত ফিরতে চাই।
নিউজ সোর্স – ইত্তেফাক